কলকাতার বুকে লুকিয়ে থাকা এক ঐতিহাসিক সম্পদ হল বউবাজারের ‘চাইনিজ টাউন’। এই অঞ্চলটি একসময় চীনা সংস্কৃতি, স্থাপত্য এবং ব্যবসার কেন্দ্রস্থল ছিল। আজ যদিও অনেকটাই হারিয়ে গেছে, তবুও এখানে এখনও ভারত-চীন সংস্কৃতির অপূর্ব মিশ্রণ দেখা যায়। আসুন জেনে নেই বউবাজারের চাইনিজ টাউন এবং হারিয়ে যাওয়া প্যাগোডা গলির ইতিহাস, যা কলকাতার ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কলকাতায় চীনা সম্প্রদায়ের আগমন
১৭৮০ সালে যখন প্রথম চীনা বণিক ইয়াং আটি (Yang Atchew) কলকাতায় আসেন, তখন থেকেই শুরু হয় এই শহরে চীনা সম্প্রদায়ের বসবাসের ইতিহাস। প্রথমদিকে তারা ট্যাংরা এলাকায় বসতি স্থাপন করেন এবং চামড়া প্রক্রিয়াকরণ (ট্যানারি) শিল্পে দক্ষতা অর্জন করেন। ক্রমে ক্রমে, বউবাজার অঞ্চলে তাদের বসতি বিস্তার লাভ করে এবং এখানেই গড়ে ওঠে কলকাতার প্রথম ‘চাইনাটাউন’।
১৯শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বউবাজার অঞ্চলটি হয়ে ওঠে চীনা সম্প্রদায়ের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এই সময়ে চীনা দোকানপাট, রেস্তোরাঁ, ধর্মীয় স্থান, স্কুল এবং সামাজিক সংস্থাগুলি গড়ে ওঠে, যা ছিল তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাক্ষী।
প্যাগোডা গলি: হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস
বউবাজারের অন্তর্গত প্যাগোডা গলি ছিল চীনা সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। নাম শুনে বোঝা যায়, এই গলিতে ছিল চীনা প্যাগোডা শৈলীর স্থাপত্য। এই গলিতে অবস্থিত ছিল বিখ্যাত সি কাই মন্দির, যা ১৮৫০ সালে নির্মিত হয়। এই মন্দিরটি ছিল কলকাতার চীনা সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় স্থান, যেখানে তারা তাদের পূর্বপুরুষদের পূজা করতেন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করতেন।
প্যাগোডা গলিতে শুধু মন্দিরই ছিল না, সেখানে ছিল অসংখ্য চীনা রেস্তোরাঁ, চায়ের দোকান, ঔষধের দোকান এবং হস্তশিল্পের দোকানও। এই দোকানগুলি ১৯৪০ এবং ১৯৫০-এর দশকে তাদের স্বর্ণযুগে ছিল। সেই সময়ে প্যাগোডা গলিতে গেলে চীনের একটি ছোট্ট অংশ কলকাতায় অনুভব করা যেত।
বাংলা-চীন মিশ্র সংস্কৃতির ছাপ
সময়ের সাথে সাথে বউবাজারের চাইনিজ টাউনে বাঙালি এবং চীনা সংস্কৃতির অপূর্ব মিশ্রণ ঘটে। এই মিশ্রণ সবচেয়ে বেশি দেখা যায় খাদ্যাভ্যাসে। চীনা রান্নার সাথে বাঙালি স্বাদের সংমিশ্রণে জন্ম নেয় ‘ইন্ডিয়ান-চাইনিজ কুইজিন’, যা আজ ভারতীয় খাদ্য সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এছাড়া ভাষাগত দিক থেকেও মিশ্রণ ঘটে। বউবাজারের চীনা বাসিন্দারা বাংলা ভাষা শিখে নেন, আবার স্থানীয় বাঙালিরাও চীনা শব্দ ব্যবহার করতে শুরু করেন। এতে করে জন্ম নেয় একধরনের মিশ্র ভাষা, যা ছিল এই এলাকার বৈশিষ্ট্য।
ট্যাংরার ট্যানারি: চীনা শিল্পের কেন্দ্র
বউবাজারের পাশাপাশি, ট্যাংরা এলাকাও চীনা সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান বসতি ছিল। এখানে মূলত তারা চামড়া প্রক্রিয়াকরণ (ট্যানারি) শিল্পে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৪০ এবং ১৯৫০-এর দশকে ট্যাংরায় ১০০-এরও বেশি চীনা ট্যানারি ছিল, যা হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছিল।
চীনা ট্যানারি শিল্প তাদের বিশেষ প্রযুক্তি ও দক্ষতার জন্য বিখ্যাত ছিল। তারা উচ্চমানের চামড়া উৎপাদন করতেন যা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে সমাদৃত ছিল। এছাড়া, এই শিল্প থেকে আয় করেই অনেক চীনা পরিবার শিক্ষা ও অন্যান্য ব্যবসাতেও বিনিয়োগ করেছিলেন।
চীনা রেস্তোরাঁ: কলকাতার খাদ্য সংস্কৃতির নতুন দিগন্ত
১৯৪০ এবং ১৯৫০-এর দশকে বউবাজার ও ট্যাংরা অঞ্চলে অসংখ্য চীনা রেস্তোরাঁ গড়ে ওঠে। এই রেস্তোরাঁগুলি স্থানীয় বাঙালিদের কাছে চীনা খাবার পরিচিত করে তোলে। চাউমিন, চিলি চিকেন, সুপ, মোমো (ডিমসাম) ইত্যাদি খাবার বাঙালিদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
বিখ্যাত রেস্তোরাঁগুলির মধ্যে ছিল ‘নানকিং’, ‘কেমি’স’, ‘পাউ চিং ফা’, ‘মো চা’। এই রেস্তোরাঁগুলি শুধু খাবারের জন্যই নয়, বরং তাদের আকর্ষণীয় পরিবেশ ও চীনা সংস্কৃতির জন্যও বিখ্যাত ছিল। লাল-সোনালী রঙের সজ্জা, চীনা লন্ঠন, এবং চীনা সংগীত – এসবই ছিল এই রেস্তোরাঁগুলির বৈশিষ্ট্য।
সি কাই মন্দির: চীনা সংস্কৃতির অবিনাশী প্রতীক
প্যাগোডা গলির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থাপনা ছিল সি কাই মন্দির, যা ১৮৫০ সালে নির্মিত হয়। এই মন্দিরটি চীনা স্থাপত্যের একটি অসাধারণ নিদর্শন, যার লাল রঙের দেয়াল, টাইল-ছাদ, এবং নক্ষা-করা কাঠের কাজ ছিল অত্যন্ত মনোরম।
সি কাই মন্দিরে চীনা সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণে পূজা করতেন, এবং চীনা নববর্ষসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব পালন করতেন। এই মন্দিরে চীনা সম্প্রদায় ছাড়াও স্থানীয় বাঙালিরাও আসতেন এবং এটি ছিল দুই সংস্কৃতির মিলনস্থল।
বর্তমান অবস্থা: হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য
দুঃখজনকভাবে, ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের পর কলকাতার চীনা সম্প্রদায়ের অবস্থা খারাপের দিকে যায়। অনেক চীনা পরিবার চলে যান, ট্যানারি শিল্প ধ্বংস হয়ে যায়, এবং বউবাজারের চাইনিজ টাউন ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে।
আজ বউবাজারে প্যাগোডা গলি প্রায় হারিয়ে গেছে। সি কাই মন্দির এখনও আছে, কিন্তু তার আগের জৌলুস নেই। চীনা দোকানপাট, রেস্তোরাঁর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। যারা আছেন, তারা তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সবকিছুই পরিবর্তন হচ্ছে।
ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
কলকাতার চাইনিজ টাউন ও প্যাগোডা গলি আমাদের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদ। এই ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া দরকার। সি কাই মন্দিরের সংরক্ষণ, চীনা হস্তশিল্পের পুনরুজ্জীবন, এবং চীনা-বাঙালি মিশ্র সংস্কৃতির প্রচার – এসব করলে হয়তো আবার ফিরে পাওয়া যাবে হারিয়ে যাওয়া প্যাগোডা গলির ঐতিহ্য।
উপসংহার
বউবাজারের ‘চাইনিজ টাউন’ এবং প্যাগোডা গলি কলকাতার ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই অঞ্চলের ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং ঐতিহ্য আমাদের সকলের। এটি শুধু চীনা সম্প্রদায়ের নয়, বরং এটি ভারতের বহুসাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। আসুন আমরা সবাই মিলে এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ করি, যাতে আগামী প্রজন্মও জানতে পারে কলকাতার বউবাজারের ‘চাইনিজ টাউন’ এবং প্যাগোডা গলির গৌরবময় ইতিহাস।