কালীঘাটের সংকীর্ণ গলি: মন্দিরের পাশে লুকিয়ে থাকা তান্ত্রিকদের গুহা

Amazing Kolkata
4 Min Read

কলকাতার প্রাণকেন্দ্র কালীঘাট। এখানে রয়েছে বিখ্যাত কালীঘাট মন্দির, যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্ত দর্শন করতে আসেন। কিন্তু এই প্রসিদ্ধ মন্দিরের পাশেই রয়েছে এমন কিছু সংকীর্ণ গলি, যা অনেকের অজানা। এই গলিগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে এক রহস্যময় ইতিহাস – তান্ত্রিক সাধকদের গুহা মন্দির।

অজানা গলির রহস্য

কালীঘাট মন্দিরের পশ্চিম দিকে যদি আপনি হাঁটতে থাকেন, তাহলে পৌঁছে যাবেন এমন এক সংকীর্ণ গলিতে যেটা বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে না যে এখানে কিছু আছে। কিন্তু এই ছোট্ট গলিটাই পৌঁছে দেয় এক অদ্ভুত জগতে। স্থানীয়রা এই জায়গাকে বলেন “তন্ত্রের গলি”।

গলির ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়বে পুরনো কালের বাড়িগুলো। লাল রঙের ইটের দেয়াল, জীর্ণ অবস্থা, কিন্তু তার মধ্যেও রয়েছে এক অদ্ভুত আকর্ষণ। এখানে রয়েছে কয়েকটি ছোট ছোট মন্দির, যেগুলো বহু শতাব্দী ধরে তান্ত্রিক সাধনার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

গুহা মন্দিরের ইতিহাস

সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল গলির শেষে থাকা একটি প্রাচীন বাড়ির নীচে লুকিয়ে থাকা গুহা মন্দির। স্থানীয়দের কাছে শোনা যায়, এই গুহা মন্দিরটি প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো। এখানে তান্ত্রিক সাধকরা গোপনে সাধনা করতেন।

গুহা মন্দিরের প্রবেশ পথটি খুব সংকীর্ণ। একটি ছোট দরজা দিয়ে ঢুকতে হয়, তারপর সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে হয়। নীচে নামার পর যা দেখবেন তা আপনাকে অবাক করে দেবে। একটি বড় কক্ষ, যেখানে মাঝখানে রয়েছে কালী মায়ের মূর্তি। দেয়ালে রয়েছে নানা তান্ত্রিক চিহ্ন আর মন্ত্র লেখা।

আশ্চর্যের বিষয় হল, এই গুহা মন্দিরে বসে বাইরের কোন শব্দ শোনা যায় না। চারপাশে একটা অদ্ভুত নীরবতা, যা আপনাকে ধ্যানে বসতে সাহায্য করে।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের স্মৃতি

কালীঘাটের এই অঞ্চলটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের কারণে। তিনি নিজেও তান্ত্রিক সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। কথিত আছে, তিনি এই গুপ্ত গলির মন্দিরগুলোতে প্রায়ই আসতেন এবং এখানকার সাধকদের সাথে আধ্যাত্মিক আলোচনা করতেন।

স্থানীয় বৃদ্ধরা বলেন, রামকৃষ্ণ একবার এই গুহা মন্দিরে ১২ দিন ধরে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। সেই সময় তিনি কালী মায়ের দর্শন পেয়েছিলেন বলে কথিত আছে।

স্থানীয়দের বিশ্বাস ও রহস্যময় অনুভূতি

এই গলি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে নানা রকম কথা প্রচলিত আছে। অনেকে বলেন, পূর্ণিমার রাতে এখানে তান্ত্রিক মন্ত্র উচ্চারণের শব্দ শোনা যায়, যদিও সেখানে কেউ থাকে না।

৭৫ বছরের বৃদ্ধ কালীপদ চক্রবর্তী বলেন, “আমি জীবনের ৭০ বছর এই এলাকায় কাটিয়েছি। অনেক রাতে শুনেছি গলির শেষের দিক থেকে ঢাক, ঘণ্টা আর শঙ্খের আওয়াজ আসছে। কিন্তু সেই সময় গিয়ে দেখলে কাউকে পাওয়া যায় না।”

এই ধরনের গল্প শুনলে হয়তো ভয় লাগতে পারে, কিন্তু স্থানীয়রা বলেন এটি ভয়ের কিছু নয়। তাঁরা বিশ্বাস করেন, এই শব্দগুলি হল সেইসব প্রাচীন তান্ত্রিকদের আত্মার, যারা এখনও তাদের সাধনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

আজকের অবস্থা

বর্তমানে এই গলি আর গুহা মন্দির অনেকটাই অবহেলিত। পর্যটকরা প্রধান কালীঘাট মন্দির দেখতে আসেন, কিন্তু এই ঐতিহাসিক স্থানগুলো সম্বন্ধে জানেন না। কয়েকজন বয়স্ক লোক এখনও এই মন্দিরে পূজা দেন এবং এর যত্ন নেন।

সরকারি কোনো সংরক্ষণের আওতায় না থাকায় এই ঐতিহাসিক স্থানটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় কিছু যুবক এখন উদ্যোগ নিয়েছেন এই জায়গাটিকে সংরক্ষণ করার।

ভিজিট করার সময়

আপনি যদি কালীঘাট মন্দির দেখতে যান, তাহলে অবশ্যই এই গলিটি ঘুরে দেখতে পারেন। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৬টার মধ্যে আসাই ভালো। রাতের বেলা এই জায়গাটি বেশ নির্জন হয়ে যায়, আর অনেক জায়গায় আলোর ব্যবস্থাও নেই।

গুহা মন্দিরে প্রবেশ করতে চাইলে স্থানীয়দের সাহায্য নিতে হবে, কারণ এটি সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। এছাড়া, মন্দিরে প্রবেশের জন্য একজন পুরোহিতের অনুমতি নিতে হয়।

শেষ কথা

কলকাতার ব্যস্ত জীবনের মাঝে কালীঘাটের এই সংকীর্ণ গলি আর গুহা মন্দির যেন এক অন্য জগতের দরজা খুলে দেয়। এখানে এলে মনে হয় সময় যেন থেমে গেছে। প্রাচীন বাংলার তান্ত্রিক সাধনার ইতিহাস এখানে আজও জীবন্ত।

এই স্থানগুলো শুধু ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণই নয়, বাঙালি সংস্কৃতি আর আধ্যাত্মিকতার এক অমূল্য সম্পদ। আমাদের উচিত এই ধরনের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা, যাতে আগামী প্রজন্মও বাংলার এই সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্বন্ধে জানতে পারে।

Share This Article
Leave a Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *