শোভাবাজার রাজবাড়ি থেকে ঠাকুরদালান: উত্তর কলকাতার রাজসিক গলির গল্প

Amazing Kolkata
5 Min Read

উত্তর কলকাতার বুকে শোভাবাজার। আজ যেখানে পুরনো বাড়ি আর গলির ভিড়, সেই জায়গাতেই একসময় বাংলার সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজপরিবারের বসবাস ছিল। চলুন আজ আমরা সেই ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখি, কীভাবে শোভাবাজার রাজবাড়ি থেকে ঠাকুরদালান পর্যন্ত এই অঞ্চল বাংলার সংস্কৃতি, ইতিহাস আর ঐতিহ্যের এক অমূল্য সম্পদ হয়ে উঠেছিল।

নবকৃষ্ণ দেববাহাদুর: এক অসামান্য ব্যক্তিত্ব

শোভাবাজার রাজবাড়ির ইতিহাস শুরু হয় মহারাজা নবকৃষ্ণ দেববাহাদুর দিয়ে। ১৭৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করা এই মানুষটি শুধু ধনী ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা। ব্রিটিশদের সাথে তাঁর সখ্য ছিল, আর সেই সুযোগ তিনি নিজের উন্নতির জন্য কাজে লাগিয়েছিলেন।

নবকৃষ্ণ শুরুতে রবার্ট ক্লাইভের দোভাষী হিসেবে কাজ করতেন। পলাশির যুদ্ধে (১৭৫৭) ক্লাইভকে সাহায্য করায় তিনি ‘রাজা’ উপাধি পান। এরপর আরও অনেক বিষয়ে তাদের সাহায্য করে ‘মহারাজা’ হন। মজার ব্যাপার হল, যে সময়ে বেশিরভাগ বাঙালি ব্রিটিশদের পছন্দ করত না, তখন নবকৃষ্ণ ঠিক উল্টো পথে হেঁটেছিলেন। তিনি দুই সংস্কৃতির মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করেছিলেন।

শোভাবাজার রাজবাড়ি: বাঙালি আর ইউরোপীয় শৈলীর মিলন

১৭৫৭ সালে, নবকৃষ্ণ প্রথম শোভাবাজার রাজবাড়ি (বড় রাজবাড়ি) নির্মাণ করেন। এই বাড়িটি শুধু একটি বাসস্থান ছিল না, এটি ছিল সেকালের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।

রাজবাড়ির স্থাপত্য শৈলী দেখলে অবাক হতে হয়। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে এটি একটি পশ্চিমা ম্যানশন, কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে বাঙালি ঐতিহ্যের ছাপ। ঠাকুরদালান, নাটমন্দির, বৈঠকখানা – প্রতিটি অংশ ছিল সমৃদ্ধ কারুকার্যে পূর্ণ।

নবকৃষ্ণের মৃত্যুর পর, তাঁর পুত্র রাজকৃষ্ণ দেব আরেকটি রাজবাড়ি নির্মাণ করেন (ছোট রাজবাড়ি) ১৮৩৫ সালে। দুটি রাজবাড়িই উত্তর কলকাতার গর্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ঠাকুরদালান: দুর্গাপূজার অন্যতম কেন্দ্র

শোভাবাজার রাজবাড়ির আরেক অমূল্য সম্পদ হল এর ঠাকুরদালান। এখানে দুর্গাপূজা শুরু হয় ১৭৫৭ সালে, ক্লাইভের পলাশির যুদ্ধে জয়ের সম্মানে। এই পূজা কিন্তু সাধারণ পূজা ছিল না। মহারাজা নবকৃষ্ণ বিশাল আড়ম্বরে এই উৎসব পালন করতেন।

ঠাকুরদালানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হল এর স্থাপত্য। বিশাল থাম, উঁচু ছাদ, নক্ষীকাঁথার মতো কারুকার্য – সবকিছু মিলিয়ে এই হলটি ছিল একটি শিল্পকর্ম। আজও দুর্গাপূজার সময় ঠাকুরদালান জীবন্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু আজকের পূজা আর আগের মতো নেই – সেই রাজসিক আড়ম্বর, বিশাল ভোজ, নৃত্য-গীত সব কিছুই কমে গেছে।

বারোয়ারি দুর্গাপূজার জন্ম: গৌরীবাড়ির কাহিনি

বাংলার প্রথম বারোয়ারি (সর্বজনীন) দুর্গাপূজার জন্ম হয়েছিল এই অঞ্চলেই। ১৭৯০ সালে, গৌরীবাড়িতে দ্বাদশ বন্ধু মিলে প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। তাই এই পূজাকে বলা হয় “বারোইয়ারি” বা “বারোয়ারি”।

এটা অনেকে জানেন না যে, গৌরীবাড়ির এই পূজা আসলে শোভাবাজার রাজবাড়ির রাজবংশের সাথে সংযুক্ত। এই উদ্যোগ পুরো বাংলার পূজা সংস্কৃতিকে বদলে দিয়েছিল। আজ আমরা যে সর্বজনীন দুর্গাপূজা দেখি, তার শুরু ছিল এখান থেকেই।

লালবাড়ি ও নবরত্ন মন্দির: অজানা ইতিহাস

শোভাবাজার অঞ্চলে ঘুরলে আরও অনেক ঐতিহাসিক স্থাপত্য চোখে পড়বে। যেমন লালবাড়ি, যেটি ১৮ শতকে নির্মিত হয়েছিল। এর নাম লালবাড়ি কেন? কারণ এটি লাল রঙের ইট দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। এছাড়া আছে নবরত্ন মন্দির, যেখানে নয়টি শিবলিঙ্গ আছে।

এই সমস্ত স্থাপত্য দেখলে বোঝা যায় সেকালের বাঙালি কতটা উন্নত ছিল স্থাপত্যকলায়। বাঙালি আর ইউরোপীয় স্থাপত্যের অপূর্ব মিশ্রণ দেখা যায় এখানে, যা কলকাতার অন্য কোথাও দেখা যায় না।

গোপন কাহিনি: লোকমুখে যা শোনা যায়

রাজবাড়ি নিয়ে অনেক গোপন কাহিনি লোকমুখে প্রচলিত আছে। একটি জনপ্রিয় গল্প হল মহারাজা নবকৃষ্ণের গুপ্তধন নিয়ে। বলা হয়, রাজবাড়ির নীচে একটি সুড়ঙ্গ আছে যেখানে বিপুল সম্পদ লুকিয়ে রাখা আছে। কেউ কেউ বলেন, রাতের বেলা রাজবাড়িতে আত্মার আওয়াজ শোনা যায়।

আরেকটি মজার কথা হল, নবকৃষ্ণ নাকি প্রতিদিন সকালে গঙ্গাস্নান করতেন এবং একশো একটি ব্রাহ্মণকে দান করতেন। তাঁর জন্মদিনে তিনি একটি স্বর্ণনির্মিত তুলাদণ্ডে নিজেকে ওজন করে সমপরিমাণ স্বর্ণ দান করতেন। এইসব গল্প সত্যি কি না জানা নেই, তবে এগুলো রাজবাড়ির ঐতিহ্যকে আরও রহস্যময় করে তোলে।

বর্তমানে শোভাবাজার: ইতিহাসের সাথে সাথে বাঁচা

আজ শোভাবাজার অঞ্চল অনেক বদলে গেছে। রাজসিক সেই দিনগুলো আর নেই। কিন্তু রাজবাড়ি, ঠাকুরদালান, পুরোনো মন্দিরগুলো এখনও দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে।

বর্তমানে শোভাবাজার রাজবাড়ি একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। প্রতি বছর দুর্গাপূজার সময় হাজার হাজার মানুষ এখানে ভিড় করে। তবে এটা দুঃখজনক যে, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলো ধীরে ধীরে ক্ষয় হচ্ছে।

শেষ কথা

শোভাবাজার রাজবাড়ি থেকে ঠাকুরদালান – এই যাত্রাপথ আসলে বাঙালি সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটা শুধু ইটের বাড়ি নয়, এটা আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ইতিহাস, আমাদের অস্তিত্বের একটি অংশ। যখনই আমরা এই গলিগুলোতে হাঁটি, মনে হয় যেন সেই পুরোনো দিনগুলোতে ফিরে গেছি।

আজ যখন আমাদের ঐতিহ্য ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে, তখন এই সমস্ত স্থাপত্য আমাদের মূল শিকড়ের সাথে যুক্ত রাখে। শোভাবাজারের গলিগুলো ঘুরতে ঘুরতে আজও হারিয়ে যাওয়া সেই রাজসিক দিনগুলোর স্বাদ পাওয়া যায়। আসুন, আমরা এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।

Share This Article
Leave a Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *